এক
বাইরে ঢাকের শব্দ। চিরন্তন এই শব্দের সাথে বাংলার কে পরিচিত নয়? শরতের শিউলি ফোটে এই শব্দে; এই শব্দে বাংলাদেশের ধান গাছেরা গর্ভবতী হয়, শিষের মাথায় শিশির নিয়ে হাসে, এই শব্দে হরেক রকম পিঠার আয়োজন, এই শব্দের রেশ ধরেই মা লক্ষী গুটি গুটি পায়ে বাঙালির ঘরে প্রবেশ করেন আর বাঙালির নেতিয়ে পরা মন চাঙ্গা হয়। কেবল জাগনন্দই হাসফাঁস করে।
বোঝার মতো চল্লিশটা বছর সে এই জীবনটা টেনে হিঁচড়ে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তবু মনে হয় সহস্রবছরেও এই অনতিক্রম্য পথ শেষ হবার নয়। আজ কত বছর নিজে বাংলাদেশি হয়েও নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় দেয়নি। বাংলাদেশের কারো সঙ্গে দেখা হলে একটা অহেতুক ভয়ে সে নিজেকে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে অন্যপথে বাড়ি ফিরেছে। যাদের সঙ্গে জানা শোনা ছিল তাদের সঙ্গে দেখা হোক কখনো চায়নি জগানন্দ। অথচ মন খুলে দুটো কথা বলতে কত না আকুলি-বিকুলী করত তার অন্তরাত্মা তবুও সেই ইচ্ছের শতসহস্র ডানাগুলো সংযমের কাঁচি চালিয়ে ছেটে ছুটে এতকাল নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করেছে সে।
এই রহস্যময় আচরণ নিয়ে মহল্লায় নানা রসালো গল্প চালু হয়েছিল, পাত্তা দেয়নি জগানন্দ। কাশির দমকটা সামলে নিয়ে পাশ ফিরে শোয় সে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। দিন যত যায় মৃত্যুভয় তাকে তাড়া করে বেড়ায়। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বহুবছর আগেই লোপ পেয়েছে তবুও মরতে চায় না সে। জগানন্দ জানে মৃত্যু তার পায়ে পা রেখে হা-ডু-ডু খেলছে। মরার পরে যে অদৃশ্য লোক আছে-কে জানে জগানন্দকে এই যন্ত্রণা সেখানে কত দিন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে! কাশিটা আবার ছলকে ওঠে গলার কাছে। সাদা কালো বিড়ালটা বার দুই জগানন্দের পা ঘেষে লেজ উচিঁয়ে মিউ মিউ করে ডাকে। কী বলতে চায় বিড়ালটা? জানে না সে। জানার কথাও নয়। রুপকথার সেই নিঃস্বার্থ যুবক হেইলিবু-র মতো তার কাছে তো আর ড্রাগনের দেয়া মূল্যবান পাথর নেই যা দিয়ে সে পশু পাখির ভাষা বুঝতে পারবে!
জগানন্দর বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে। এই বুঝি যমরাজ বিড়ালের ছদ্মবেশে তার কাছে এলেন। একটানা কাশতে থাকে জগানন্দ। গলাটা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে। সামনে টিপায়ের ওপর ঢাকা দেয়া জলভর্তি গ্লাস। হাত বাড়ালেই নিতে পারে সে, হাতটা নাড়তে পাড়ছে না। বার বার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিচ্ছে। বারকতক মিনমিনে গলায় ছোট মেয়েটার নামধরে ডাকলো। সে ডাক ঢাকের শব্দে কোথায় মিলিয়ে যায়, দেবকী আসে না। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে ঢাকের শব্দ জোড়ালো হচ্ছে। উলুধ্বনিতে অপশক্তি তাড়ানোর প্রয়াস গাঢ় হচ্ছে। কাজের মেয়েটা কারেন্টের সুইচটা অন করে ধুপদানি হাতে ঘরে ঢোকে। ধূপের ধোয়া ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। জগানন্দ চিৎকার করতে চায়-শব্দ বের হয় না। উঠে বসতে চায়-পারে না। তার কেবলই ভয় করতে থাকে, এইবুঝি তার চিতার ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আম আর জারুল গাছের ফাঁক গলে। নারকেল গাছের শাখা চামর দুলিয়ে সেই ধোঁয়া কোন এক অদৃশ্য লোকে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে জগানন্দ সেখানে যেতে চায় না। ঢাকের চমৎকার রিদমটা বল হরি, হরি বোল বল হরি, হরি বল ছাড়া আর কোন ম্যাসেজই দিতে পারে না জগানন্দকে।
আজ বড় ইচ্ছে করছে একবার অন্তত একবার দেশে যেতে যেখানে মা তার জন্মের পর নাড়ি পুঁতে রেখেছেন, যেখানে তার ঠাকুর্মা তার বাবার নাড়ি পুঁতেছিলেন আর তারই শ্বশুড়ের চিতায় রোজ সন্ধ্যাবাতি জেলে প্রণাম করতেন। সেই কাঁঠালতলা যেখানে পড়ন্ত বিকেলে রোজ নরেশ, সুরেশ আর বরেনদের সাথে মারবেল খেলতো সে; সেই মাঠ, কচি ধানের ক্ষেত যার আলপথে হেঁটে হেঁটে ঘুড়ি উড়িয়েছে চৈত্রের শেষ দুপুরে। সেই খাল যেখানে জোড়া ঝুনো নারকেল বেঁধে সাঁতার শিখছে আর… চমকে ওঠে জগানন্দ। এই একটা মুখ সে কিছুতেই মনে করতে চায় না। বড় ভয় হয়। বড় যন্ত্রণা হয়। অথচ এই মানুষটা তাকে শিশুবেলায় কত অভয় দিয়েছে। মনে পড়ে, নিম পাখির একটানা ডাক যখন দুপুরকে বিদীর্ণ করত জগানন্দর সমস্ত শরীর ঝিম মেরে যেত। সহসা বাইরে বেরোত না। সন্ধ্যায় সেই নিম পাখি যখন বিদঘুটে ভঙ্গিতে ডাকত জগানন্দ সেই যে মায়ের আঁচল ধরত ছাড়তই না। মা যখন আবিস্কার করলেন কুক্ কুক্ ডাকশুনে জাগা ভয় পায় তখন বুকে টেনে নিয়ে তিনি অভয় মন্ত্র শিখান। যতবার পাখিটা কুক বলবে ততবার তুমি কৃষ্ণ বলবে। দেখবে, কোথায় গেছে সেই পাখি!
মার কথার মূল্য সে দিত। এক সময় দেখতো, সেই পাখি আর ডাকে না। খুশি হত জগা। সেই খুশি দেখে মার চোখ মুখ কেমন চকচক করে উঠতো। এই মায়ের মুখটাই দীর্ঘ চল্লিশটা বছর সন্তপর্ণে আড়াল করতে চেয়েছে সে। যতই এই চেষ্টা করেছে ততই মনে পড়েছে আর যতই মনে পড়েছে তত সে পালিয়ে বেড়িয়েছে অন্যের কাছ থেকে নিজের কাছ থেকে। আজ আর সে পালাতে চায় না। আজ তার মৃত্যু ভয় জয় করবার এক অদম্য ইচ্ছে মনের কোনে উঁকি দিচ্ছে। পিট পিট করে সে তাকায়, সামনে কাঁচের জগে টলটল করছে জল। গ্লাস ভর্তি জল ঢাকা দেয়া বিয়ের নেমরন্তন্নের একটি কার্ড দিয়ে। ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় সে।
চার বছরে এই তৃষ্ণা তার মর্জিমত সময় এসে কেউ মেটায় নি। দু’চামচ জল মুখে দিয়ে বিদায় হয়েছে। আর একটু জল খাব-এ কথাটা বলতে পারেনি। কন্ঠনালী ভেদ করে শব্দরা যখন ঠোঁটে এসেছে তখন ব্যস্ত মেয়ে বেড়িয়ে গেছে ঘর ছেড়ে।
দুই
কোথায় কখন কিভাবে কার বিচার হয় কে বলতে পারে? জগানন্দ কি কোনদিন ভেবেছিল হাতের কাছে পানি থাকতেু বুক ফাটা তৃষ্ণা নিয়ে থাকতে হবে? ঠা ঠা রোদ মাথায় করে জগানন্দ ঘর ছেড়েছিল দুই মেয়ে, পোয়াতি বৌ আর অন্ধপ্রায় বৃদ্ধা মাকে নিয়ে। জগানন্দ একা নয়-সঙ্গে ছিল গায়ের প্রায় সবাই। তাদের চোখে মুখে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। বসত ভিটার মায়া ত্যাগ করে সহায় সম্বলহীন মানুষ ছুটছে আজানার উদ্দেশ্যে, গন্তব্যহীন গন্তব্য, কত পথ! কত ক্লান্তি! তবু চোখে মুখে সবার বাঁচবার তীব্র আশা। কবে তারা পাবে নিরাপদ আশ্রয়।
দু’দুটো বাচ্চা মেয়ে, সাথে তিন মাসের অন্তসত্তা বৌ, অন্ধ বৃদ্ধামা, কি আশ্চর্য! পরিচিতরাও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, দুটো কথা বলবার সময় নাই, ফুরসৎ নাই। কে কার দিকে ফিরবে? সবারই তাড়া সবাই বাঁচতে চায়। কার না আছে প্রাণের মায়া? জগানন্দ যে পথ দশদিনে যেতে পারত সেই পথ তাকে যেতে হচ্ছে আঠার দিনে। তবুও মনে তার খেদ নাই ক্ষোভ নাই। পথে যেতে যেতে কত লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে এখানে সেখানে। গুলিবিদ্ধ মৃত মায়ের বুকের ওপর উবুর হয়ে কাঁদছে শিশু। ছোট্ট হাতে তৃষ্ণার্ত শিশু খুঁজছে পায়োধর। এই দেখে থমকে দাঁড়ায় কমলা। সাথে নিতে চায় বাচ্চাটাকে। জগানন্দ টেনে ধরেছে কমলার হাত।
‘আদিখ্যেতা করবার সময় এটা না। কমলা আঁচলে চোখ মোছে। খালে ভেসে যেতে যেতে দেখছে সদ্য ধর্ষিতা মেয়ের বিবস্ত্র লাশ। তাজা রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পানিতে পা ডুবিয়ে পার হতে হয়েছে খাল। তবু তাকাবার সুযোগ নাই। ভাববার অবকাশ নাই। হাঁটা দৌড়ে সবাই ব্যস্ত। গন্তব্য সবার এক। ওপাড়। কী আছে ওপারে? কে আছে? জানে কেউ, কেউ বা জানে না। তবু সবাই চায় দেশ ছাড়তে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পথে পানি পিপাসায় মেয়েরা কাতর। পানিটুকু শেষ। ছোটটার তৃষ্ণা মেটাতে মায়ের বুকে দুধ মজুদ আছে। এটাই যা বাঁচোয়া। মাঠের পর মাঠ বিরান, রোদের তাপে মাটি ফেটে চৌচির। সামনে একটা ভিট দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি বলেই তো মনে হয়। পথ ছেড়ে বিপথে হাঁটে জগা। বাড়িটা থেকে একটু পানি নেয়া যায় যদি! জগার সাথে হেঁটে পারে না মা আর কমলা। জগা থামে, ঘুরে দাঁড়ায়, তাগাদা দেয়, আবার হাটে, হাঁটতে হাঁটতে সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। একফোটা বৃষ্টির জন্য তারা কি না করত। হাতে হাত রেখে নাচত, গাইত-
কালো মেঘা নামো ফুল তোলা মেঘা নামো
ধূলট মেঘা তুলট মেঘা তোমরা সবাই নামো।
কালো মেঘা টলমল বার মেঘার ভাই
আরো ফুটিক পানি দিলে চিনার ভাত খাই।
কালো মেঘা নামো, নামো গো-চোখে কাজল দিয়া
তোমার কপালে টিপ দিমু মোদের হলে বিয়া
আইড়া মেঘ, হাইড়া মেঘা, কুইড়া মেঘার নাতি
নাকের নোলক বেইচ্চা দিমু তোমার মাথার ছাতি।
কৌটা ভরা সিন্দুর দিমু সিন্দুর মেঘার গায়
আইজ যেন রে দেওয়া ডাকে মাঠ ডুইবা যায়।
গুণগুণ করে গাইতে গাইতে জগা পুকুর পাড় ধরে বাড়ির মধ্যে যায়। একি! সব পুড়ে ছাই। অবশিষ্ট কিছু নাই। এ বাড়ির মানুষগুলো? ভাববার সময় নাই। বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ায় জগা। টিউবয়েল থাকে না সব বাড়ি। এ বাড়িতে আছে। বাচ্চাদের পুড়ে যাওয়া আমগাছটার নিচে দাড় করিয়ে রেখে টিউবয়েলে হাত রাখে। বিটক শব্ধে কেঁপে ওঠে সেটা। পানি নাই। হাতের কাছে এমন কিছু নাই যা দিয়ে ডোবা কে কে পানি এনে টিউবয়েলে দেয়। একটা পেঁপে গাছ তলায় মাটির বদনা দেখতে পায় জগা। বদনা আনতে গিয়ে দেখে তখনও কমলা আর তার মা-ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটছে। হাত উচিয়ে সাড়া দেয় জগা-তাড়াতাড়ি আস।
একটুখানি বিশ্রাম নেয়া হলে আবার নেমে পড়ে। বড় মেয়ে কোলে, ছোট মেয়েকে কাঁধে নিয়ে উদোম গায়ে হাঁটতে শুরু করে জগা। তার পিছে পিছে হাটে বৌ আর মা। মা তার লাঠি ভর দিয়ে বৌ’র হাত ধরে এগোয়। সন্ধ্যা নামার আগে একটা আশ্রয় চাই। জগা পা চালায়, কাঁধের মেয়েকে নামিয়ে বলে-এক পা হাট দিকিনি।
মেয়ে ক’কদম হাটে-এবড়ো থেবড়ো চকের মধ্য বড়রাই হাঁটতে পারে না, মেয়ে হাটবে কি? অগত্য আবার কাঁধেওঠে মেয়ে। স্বামীর কষ্ট বুঝতে পেরে ছোটটাকে কোলে নেয় কমলা। এবার মায়ের হাত ধরে জগা। মায়ের কোলের ছোট পুটলিটা নিজের হাতে নেয়। বাপের গলা ভালো করে জড়িয়ে ধরে কাধের মেয়েটা। মাকে তাড়া দেয় জগা-
একটু তাড়াতাড়ি কর।
ভয় উদ্বেগ আর বিরক্তি একাকার হয়ে ঝড়ে পড়ে জগার কন্ঠে। মাঠের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সংকীর্ণ ছায়ায় এসে দুম করে বসে পড়ে কমলা। আর পারব না গো! এরচে বাড়িতে থাকাই ভালো ছিল; মরতাম মরতাম নিজের বাড়িতে মরতাম। শান্তি আছিল। জগা উত্তর দেয় না। মাকে বসতে বলে নিজেও বসে। সামনে মাঠের মধ্যে হলুদ হয়ে পেকে রয়েছে বাঙ্গি। শরণার্থিরা যাবার পথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করছে। জগানন্দ একবার ভাবে সেও ছিঁড়বে শেষ পর্যন্ত পারে না-সংযত হয়। ছোট্ট মেয়েটা ততক্ষণে মায়ের বুকের মধ্যে নাক ডুবিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজে খাচ্ছে।
সূর্য ডুবু ডুবু করছে। গ্রাম এখনো অনেক দূর। আরো কত পাটক্ষেত ধানক্ষেত, বাঙ্গি আর তরমুজের ক্ষেত ডিঙ্গোতে হবে কে জানে! আবার হাঁটতে শুরু করে জগার পরিবার। পিছনের মানুষগুলো তাদের শত হাত পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়, জগার ভিতরের পৌরুষ গমগম করে। মন খারাপ হয় জগার। তাদের মত শত শত শরণার্থি আশ্রয় নিয়েছে এ বাড়িতে। গৃহস্থ বাড়ি দেখে উঠতে পারলে ভালো হয় অন্তত একটা দিনের খাবারের ব্যয় লাঘব হয়। আজ এখানে আশ্রয় হবে না। এত মানুষের মধ্যে-একটু না ঘুমাতে পারলে হয়? জগা হাঁটতে থাকে –ঐ তো একটা টিলা বাড়ি। একটা ঢেকি ঘর ছাড়া কিছুই নেই। তার মানে হল এরাও শরনার্থি হয়ে দেশ ত্যাগ করেছে, বেশি ভাবে না জগা। কমলা ক্ষুদ নিয়ে খালের ঘাটে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে। একপাশে পড়ে আছে মুন্ডবিহীন মেয়ের বিবস্ত্র লাশ। আর কি ইচ্ছে হয় রান্না করে খেতে? তবু দুটো বেগুন আর তিনটে ঢেড়শ সেদ্ধ দিয়ে বৌভাত চাপায় কমলা। পোটলা খুলে লবণ বের করে দেয় জাগা। বেগুন ঢেঁড়শ আর দুটো কাঁচা মরিচ এ বাড়িতেই পেয়েছে। গাছ থেকে এগুলো ছিড়তে গিয়ে কমলা অন্যমনস্ক হয়ে যায়- কিসুন্দর ভিটে বাড়ি এই ফেলে কার সাধ দেশান্তরি হয়? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। নিজের বাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়। কমলার চোখের পাতা ভিঁজে ওঠে। আর কি ফেরা হবে? কোনদিন?
ঘরের পিছন থেকে বিশেষ কায়দায় কলাপাতা ছিঁড়ে আনে জগা। খেতে বসে সবাই। বড় মেয়েটার বায়না, মাছ চাই তার…মাছ ছাড়া কিছুতেই খাবে না সে। কিছুতেই না। শেষে বাপের ধমক খেয়ে মাছের ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে খেতে শুরু করে-তবু তার নানা অজুহাত-ভর্তায় তেল কই? তেল দাও।
কমলা টের পায় জগানন্দ ফুসছে। সে মেয়েকে কাছে ডাকে, কানে কানে কি একটা বলে তবু তার তেল চাই, তেল ছাড়া ভর্তা হয়? পাশ থেকে ঠাকুমা-নাতনির পিঠে হাতবুলায় ‘খাও দাদু-তেল তো ফুরাইয়া গেছে-সামনে হাট বাজর পাইলে বাবারে কব তেল কিনতে! তবু থামে না মেয়ের বায়না। আমি খাব না।’
এবার বাজখাই ধমক দেয় জগা। তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে অন্ধ মা’ তুই থাম জগো। তুই কি কম করছস? কম
জ্বালাইছস? ওরে দাবর দিবি না। মুহূর্তে বৃদ্ধার চোখ জলে ভরে ওঠে। এই কি তার ভাগ্যলিপি! এ জন্যই কি প্রতি বৈশাখে হরিচরণে মালতি ফুল দিয়েছে? ধান দুর্বা জলে ভাসিয়েছে সে?
মায়ের চোখে জল দেখে জগা বিরক্ত হয়-তোমার আবার কি হল? খাওন সামনে কান্দ ক্যান? মেয়ের দিকে কটমট করে তাকায়-একটা ভাত ফ্যালাইয়া উঠবি না, সব খাবি। ছোট মেয়েটা একবার বাবার পাত থেকে একবার মার পাত থেকে ভাত নিয়ে মুখে দেয়-ছড়ায়। জগা সেদিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে ওঠে। জিভ বের করে মেয়েকে ভেংচি কাটে-মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে এক পা উপরে তুলে সেও বাপকে ভেংচি কাটে। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত চিন্তা দুর্ভাবনা উড়ে যায় জগার। অনাবিল শান্তি ছুয়ে যায় কমলাকেও।
আর একটু কষ্ট কর-এই তো আইসা পরছি.. ওই তো দেখা যায় ভারত। কমলাকে বলে জগা। উ-উ-ই-যে আঙ্গুল তুলে দেখায় জগানন্দ। বৃদ্ধার আর চলে না। ওবাবা জগো-জগোরে…থাম না বাপ। আমি যে পারছিনা বাপ…ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বৃদ্ধা বসে পড়েন। মাজা কেমন বিষ করছে। পার পাতা টনটন করছে। ও-বাবা, জগোরে একটু জল দে বাপ। জল কই পাব! দেখছ না ধারে কাছে কোন বাড়ি ঘর নাই! বিরক্তির শেষ ধাপে গিয়ে জগার কন্ঠ চড়ে যায়।
ঐ তো! আর একটু কষ্ট কর। মাকে হাত ধরে টেনে তোলে জগা। বৃদ্ধা ছেলের হাত ধরে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ায়। হাঁটতে থাকে জগার হাত ধরে-পথের বাঁক শেষ হতেই থমকে যায় জগা। এ-কি! সামনে হাটু ডুবানো থকথকে কাদা। পা ফেলে পা তোলা মশকিল। কে জানে কতটা পথ হবে। কেউ বলছে-এক্কেবারে বডার পর্যন্ত পাক্কা মাইল পাঁচেক তো হবেই। তার বেশি হলেও পারে। এখন? কাকে বলবে বাচ্চা দুটো পার করে দিতে? আর মা? জগানন্দ চোখে সর্ষে পুল দেখে-উপায়? মা তার বসে পড়েছে বাবলা গাছের নিচে। বেলা পড়ে গেছে। কে চায় পিছনে ফিরতে! এখানে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। ফাকা মাঠের মধ্যে থাকা সম্ভবও নয়। বৃদ্ধা আকুলি বিকুলী শুরু করেছেন ও বাপ একটু জল দে-একটু জল দে বাপ-গলা শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেলরে -ও বাবা জাগো।
তুমি চুপ কর! একটু জল না খাইলে কি হয়? পাচ মাইল পেরী পাড়াইয়া কেমনে পাড় হব হেই চিন্তায় বাঁচি না জল জল করছে? ধমকে ওঠে জগা। বৃদ্ধা ছেলের ধমক খেয়ে চুপ। এই হুহূর্তে হঠাৎ জনরব ওঠে’ তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি কর। শান্তি বাহিনী আসছে। কখন গোলাগুলি হয় কওয়া যায় না।’ এবার জগানন্দের বুক শুকিয়ে যায়। মুহূর্তে বৌকে বলে ঐ লোকটার পেছনে পেছনে হাঁট। আমি আসছি।
কমলা স্বামীর নির্দেশ মেনে কাপড় তুলে কাদায় পা রাখতেই বুড়বুড় করে ডুবে যায় হাঁটু পর্যন্ত। জগা লুঙ্গিটা মালকোচা দেয়। বড় মেয়েকে কাধে আর ছোট মেয়েকে গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে নেয়। কিন্তু মাকে কি করবে? বৃদ্ধা এতক্ষণ চুপছিল। আর বুঝি পারে না। বুকের ছাতিটা তৃষ্ণায় ফেটে যাবার উপক্রম। জগো, জগোরে-বাপ তোর পায় পরি কারো কাছ থেকে একটু জল আইনা দে বাপ। জল ছাড়া যে বাঁচব না জাগো। কে দেবে জল? সবাই ভয়ে অস্থির। কে দাঁড়ায় কার জন্য? ওদিকে কমলাও অদৃশ্য হয়ে গেছে-এদিকে অন্ধ অসহায় মা! কি করবে সে? মা, ঠিক আছে একটু বস। আমি তোমার জন্য জল আনাইছি সেই যে জগানন্দ কাদায় পা ডুবালো আর তার ফেরা হয়নি তৃষ্ণার্ত অন্ধ মায়ের কাছে…
আজ চল্লিশ বছর পর…তৃষ্ণার্ত ভয়ার্ত অসহায় জগো প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে…কত শত আলোক বর্ষ অতিক্রম করলে সে পৌঁছবে তার মায়ের কাছে? ঐ তো মা তার বসে আছে বাবলা গাছের তলায়-এখনো মা তার জন্য অপেক্ষ করে আছে। জগো ও বাবা জগো জল পাইলি বাপ? আমি যে আর পারছি না-ওজগো জগোরে…
জগা দৌঁড়ায়। দৌড়াতেই হুড়মুড় করে এসে নেমে পড়ে সেই ঘন থকথকে কাদার মধ্যে। ঐ তো এখনো মা তার বসে আছে-জগো কাদায় ডুবে যাচ্ছে। একি! পা তুলতে পারছে না-ডুবছে তো ডুবছেই… কোমর ছাড়িয়ে বুক ছাড়িয়ে কাদা এসে গলা ছুঁই ছুঁই…ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে ওঠে জগানন্দ…কতবার মাকে ডাকার চেষ্টা করেছে পারেনি। জলের গ্লাসটা বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে ঢাকা। বাইরে ঢাকের শব্দ অষ্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ:…. আর একবার শেষ চিৎকার দেয় জগা-ববলার নিচে বসে থাকা মা তার উল্টো দিকে হাঁটছে। কাদা তখন জগার নাক ছুঁই ছুঁই, শেষ চিৎকারের শব্দটা পৌঁছায় না মেয়েটার কানে। জগার চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে বালিশে…